আমাদের দেশে বর্ষাকালে প্রচুর পরিমাণ পানি পাওয়া গেলেও শুকনো মৌসুমে পর্যাপ্ত সেচের পানি পাওয়া যায়না । এ অধ্যায়ে ধান ফসলে কখন কতটুকু পানি দরকার, সেচ নালা এবং একটি সেচ পাম্প দ্বারা জমিতে কতটুকু পানি দেওয়া যাবে ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
ফসলের জমিতে কখন কতটুকু পানি সরবরাহ করা প্রয়োজন তা তিনটি বিষয়ের ওপরে নির্তনশীল । যেমন-
১। ডিউটি (Duty)
২। ডেল্টা (Delta) ও
৩। বেজ প্ৰিয়ড (Base Priod )
ডিউটি (Duty) :
জমির পরিমাণ এবং প্রয়োগকৃত সেচ পানির আয়তনের অনুপাত বা সম্পর্ককে ডিউটি বলে। জমির পরিমাণ বা ক্ষেত্রফল হেক্টরে এবং পানির আয়তন কিউবিক মিটার/সেকেন্ডে প্রকাশ করা হলে ডিউটি হবে- হেক্টর/কিউমেক। অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে এক কিউবিক মিটার হারে সম্পূর্ণ বেইস পিরিয়ডব্যাপী সেচ পানি সরবরাহ করা হলে যত হেক্টর জমির সফল পরিপক্ক করা যাবে তাকে ডিউটি বলে । উদাহরণস্বরূপ, কোনো ফসলে প্রতি সেকেন্ডে এক কিউবিক মিটার হারে ফসলে পুরো বেইস পিরিয়ড (B) ব্যাপী সেচ পানি সরবরাহ করা হলো, তাতে ২০০ হেক্টর জমির ফসল পরিপক্ক করা সম্ভব হল। তাহলে, ঐ ফসলের ডিউটি হলো 'B' দিনের বেইস পিরিয়ডে প্রতি কিউমেকে ২০০ হেক্টর। অন্য কথায়, ২০০ হেক্টর/কিউমেক, B দিনের বেইস পিরিয়ডের জন্য। ডিউটিকে নানাভাবে প্রকাশ করা হয়ে থাকে-
১। ক্ষেত্রফলে একক প্রতি প্রবাহের হার (হেক্টর/কিউমেক, একর/কিউমেক)
২। প্রবাহের একক প্রতি জমির ক্ষেত্রফল (কিউমেক / হেক্টর, কিউমেক/একর)
৩। পানির গভীরতার এককে (সেন্টিমিটার, মিটার, ইঞ্চি, ফুট)।
ডেল্টা (Delta) :
কোনো একটি ফসলে মোট প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণ গভীরতার এককে প্রকাশ করা হয়। এই গভীরতাকে ডেল্টা বলে। একে সেন্টিমিটার বা মিটার অথবা ইঞ্চি বা ফুটে প্রকাশ করা হয়। ফসল রোপণ থেকে শুরু করে কর্তন বা উত্তোলন পর্যন্ত ফসলের চাহিদা অনুযায়ী পানি দিতে হয়। ফসলের বাড়ন্ত বা বাড়তি বিভিন্ন সময়ে পানির চাহিদাও বিভিন্ন থাকে । তবে ফসলের মোট জীবনকালে যে পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয় তার মোট গভীরতাকে ডেল্টা বলে । সেচ পানি সরবরাহের যে স্থানে তা মাপা হয় অথবা হিসাব রাখা হয় তাকে এই স্থানের ডেল্টা বলে । যেমন মাঠ পর্যায়ের ডেল্টা, পাম্প পর্যায়ের ডেল্টা, খাল পর্যায়ের ডেল্টা ইত্যাদি। ডেল্টাকে গ্রিক অক্ষর A দ্বারা প্রকাশ করা হয় । ধরা যাক কোনো একটি ফসল রোপনের পরে ৫ সেন্টিমিটার, দ্বিতীয়বারে ৮ সেন্টিমিটার, তৃতীয় বারে ৭ সেন্টিমিটার, চতুর্থবারে ৬ সেন্টিমিটার এর শেষ বারে ৫ সেন্টিমিটার, পানি সেচ দেওয়া হল । তাহলে, এই ফসলের ডেল্টা হবে ৫+৮+৭+৬+৫ = ৩১ সেন্টিমিটার অথবা ০.৩১ মিটার ।
নিচের তালিকায় কয়েকটি প্রধান ফসলের ডেল্টা লক্ষ্য কর :
ধান - ১২০ সেন্টিমিটার (৪৮ ইঞ্চি)
তুলা ৫০ সেন্টিমিটার (২২ ইঞ্চি)
আখ - ৪০ সেন্টিমিটার (৪৮ ইঞ্চি)
গম - ১২০ সেন্টিমিটার (১৬ ইঞ্চি)
ভূট্টা ২৫ সেন্টিমিটার (১০ ইঞ্চি)
বেইস পিরিয়ড (Base period)
কোনো ফসলে প্রথম সেচ ও শেষ সেচ প্রদানের মধ্যবর্তী সময়কে বেইজ পিরিয়ড বলে ফসলের বীজ বপনের বা চারা রোপণের কিছুদিনের মধ্যে সর্বপ্রথম সেচ দিতে হয়। এরপর কিছুদিন পরপর এবং ফসল তোলার কিছু আগে সেচ দিতে হয় । এই সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ সেচের মধ্যে মোট যতদিন অতিবাহিত হয়, তাকে বেইজ পিরিয়ড বলে। উদাহরণস্বরূপ কোনো কোনো জাতের ধানের বেইজ পিরিয়ড ১১০ দিন। আবার, কোনো কোনো জাতের গমের বেইড পিরিয়ড ১২০ দিন বেইজ পিরিয়ডকে B দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
সেচ নালা নির্মাণ :
যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে নালার মাধ্যমে ফসলে জমিতে সেচ প্রদান করা হয়, তাকে ভূপৃষ্টস্থ সেচ নালা বলে। এ প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে গ্রীষ্ম মৌসুমে যখন চারদিকের নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর ইত্যাদির পানি শুকিয়ে যায়, তখন ভূগর্ভস্থ এই নালা নির্মাণ করে ফসলে জমিতে সেচ দেওয়া হয়। ভূগর্ভের পরিবাহী স্তর ভূ-পৃষ্ঠের প্রায় ২০ ফুট নিচে পাওয়া যায়। ভূ-পৃষ্ঠের পানি উত্তোলনের জন্য নলকূপ বসিয়ে পানি উত্তোলন সেচ ব্যবস্থা অল্প সময়ে খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সেচ নালা নির্মাণের জন্য নলকূপ স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রথমে পাইপ রেঞ্জ, চেইন রেঞ্জ, কোদাল, বালতি, আড়াই ইঞ্চি (2-2") অথবা চার ইঞ্চি (৪) ব্যাসের জি আই পাইপ, ঐ ব্যাসের সকেট, বাঁশের খণ্ড ইত্যাদি সংগ্রহ করতে হবে।
গর্ত তৈরি করা : নির্বাচিত স্থানে ১০ সে.মি ব্যাসের ১-২ মিটার গভীর করে একটা গর্ত করতে হবে। এই গর্ত থেকে আধা মিটার দুরে ১ মি. x ০.৫ মি. x ৫ মি. (৪০ ইঞ্চি x ২০ ইঞ্চি x ২০ ইঞ্চি) সাইজের চৌবাচ্চা খনন করতে হবে । একটা সরু নালী কেটে উভয় নালীকে সংযুক্ত করতে হবে।
১৫.৩ একটি সেচ পাম্প দ্বারা কতটুকু জমিতে পানি দেওয়া যায় (How much water can be in the field by an irrigation pump)
একটি পাম্প দ্বারা কতটুকু পানি উত্তোলন করতে পারে তা নির্ভর করে পাম্পের ক্যাপাসিটির উপর। পাম্প ক্যাপাসিটি (Pump Capacity) কোনো একটা পাম্প একক সময়ে সর্বোচ্চ যে পরিমাণ পানি বা তরল পদার্থ সরবরাহ বা অপসারণ করতে পারে তাকে ঐ পাম্পের ক্যাপাসিটি বা ক্ষমতা বলা হয়। এফপিএস (Feet Pound Second) পদ্ধতিতে পাম্প ক্যাপাসিটি সাধারণত ঘনফুট / সেকেন্ড (Cubic feet per Second) বা সংক্ষেপে কিউসেক হিসেবে প্রকাশ করা হয়। মেট্রিক পদ্ধতিতে এই একককে লিটার / সেকেন্ড (Litre per Second ) হিসেবে প্রকাশ করা হয় ।
২ কিউসেক ক্ষমতার পাম্প বলতে বোঝা যাবে যে, পাম্পটি প্রতি সেকেন্ডে ২ ঘনফুট পানি সরবরাহ করতে পারে। অনুরূপভাবে, ৫৬ লিটার/সেকেন্ড বলতে পাম্পটি প্রতি সেকেন্ডে ৫৬ লিটার পানি সরবারাহ করতে পারে, এ কথা বোঝায়।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. সেচ নালা কী ?
২. ডেলটা কী ?
৩. ডিউটি কী ?
৪. এফপিএস পদ্ধতিতে পাম্প ক্যাপাসিটির একক লিখ।
৫. মেট্রিক পদ্ধতিতে পাম্প ক্যাপাসিটির একক লিখ ।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. ডেলটা বলতে কি বোঝায় ?
২. ডিউটি বলতে কি বোঝায়?
৩. বেইজ প্রিরিয়ড বলতে কি বোঝায় ?
৪. সেচ নালা বলতে কী বোঝায় ?
৫. ডিউটির একক সমূহের নাম লিখ।
৬. প্রধান কয়েকটি ফসলের ডেল্টা তালিকায় উল্লেখ কর।
৭. ফসণেন জমিতে কখন কতটুকু পানি সরবরাহ করা প্রয়োজন তা যে বিষয়ে উপরে নির্ভর করে সে বিষয়গুলো কী কী?
৮. পাম্প ক্যাপাসিটি কাকে বলে? ৯. কিউসেক ক্ষমতার পাম্প বলতে কি বোঝায় ?
রচনামূলক প্রশ্ন
১. সেচ নালার কার্যপ্রণালি বর্ণনা কর ।
২. ডেলটা, ডিউটি ও বেইজ প্রিরিয়ড সম্পর্কে বর্ণনা দাও?
৩. একটি সেচ প্যাম্প দ্বারা কতটুকু জমিতে কতটুকু পানি দেওয়া যাবে তা আলোচনা কর ।
৪. ভূগর্ভস্থ সেচ নালা নির্মাণ সম্পর্কে বর্ণনা দাও?